অপরাজিতা বৈশাখী নামটা শুনেই অনেকের ভাললাগে। বাংলা ভাষায় বাঙ্গালির বাংলা মাসের প্রথম মাস বৈশাখ, সেখান থেকেই বৈশাখী। বৈশাখী কে যখন তার বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিল মাত্র কয়েক বছর পর-ই বৈশাখীর স্বামী মারা যায়। ততদিনে বৈশাখীর কোল আলো করে আসে তার পুত্র, নাম রাখে কৃষ্ণ। বৈশাখীর স্বামী অনেক সম্পদ ও অর্থবিত্ত রেখে গেলেও পুরুষহীন পরিবার বা সংসার জীবন যেন লবণ ছাড়া তরকারি। একমাত্র পুত্র কৃষ্ণ কে অনেক আদর যত্নে লালনপালন করে। পুত্রের কোনোকিছুরই কমতি রাখেনি বৈশাখী। চাওয়ামাত্রই সবকিছু পুত্রের জন্য উজার করে দেয় বৈশাখী। বৈশাখীর স্বামী অনেক সম্পদ ও অর্থবিত্ত রেখে গেলেও পুত্র কৃষ্ণের এসএসসি পরীক্ষা আসন্ন সময়েই সব অর্থবিত্ত প্রায় শেষ হয়ে যায়। তাই বৈশাখী কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে কিছু সম্পদ বিক্রি করে পুত্রের লেখাপড়ার যোগান দেয়, আর সামান্য কিছু টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনে। প্রতিবেশীদের জামাকাপড় সেলাই করে যে টাকা বৈশাখী পায় তাই দিয়েই মা-পুত্রের সংসার কোনভাবে চলে যায়। কৃষ্ণ যখন এসএসসি পাশ করে তখন বৈশাখীর অবস্থা শোচনীয় থেকে আরো শোচনীয় হয়। স্বামী ছাড়া সেই সংসারে বৈশাখী যে কিভাবে সময় অতিবাহিত করছে সে কথা শুধু সেই জানে। পুত্র কৃষ্ণ কখনোই বুঝতে চায়না যে সংসারে বাবা নেই সব চাওয়া হয়তো পূরণ হবার নয়। সে অত্যাচারী থেকে যেন আরো অত্যাচারী হয়ে ওঠে। এসএসসি পাশ করা অতটুকু ছেলেই সঙ্গ দোষে হয়ে যায় নেশাগ্রস্থ.. এভাবেই চলতে থাকে কৃষ্ণের সময়। মা বৈশাখী ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে পুত্র যেন নেশাগ্রস্থতার কবল থেকে ফিরে আসে। কিন্তু প্রার্থনা করলেই বা কি? কৃষ্ণ যেন দিনে দিনে আরো বেশি মাতাল, মনুষ্যহীন ও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। কোনভাবেই বাগে আনতে পারেনা মা বৈশাখী। এভাবেই কেটে যায় অনেক বছর। কৃষ্ণ নেশার টাকা জোগানোর জন্য তার মা বৈশাখীর একমাত্র উপার্জনের সেলাই মেশিনটাও বিক্রি করে। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি সব বিক্রি করে নেশা করে কৃষ্ণ। অনেক বছর হয়ে যায় বৈশাখী ও বৃদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের চলার কোন অবলম্বন রাখেনি পুত্র কৃষ্ণ। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কেটে যায় বৈশাখীর। মনে মনে ফুঁসতে থাকে আর নিজের কপালকেই দোষারোপ করে বৈশাখী। কখনও বা চিৎকার করে বলতে থাকে হে ভগবান, কি এমন দোষ করেছিলাম আমি যে সাজা তুমি আমায় দিচ্ছো। কোনোভাবে ভিক্ষে করে চলছে তার জীবন। ভিক্ষেও কি মানুষ সহজেই দেয়? ভিক্ষে করতে গেলে শুনতে হয় মানুষের কথার ফুলঝুরি। বিশেষ করে পুত্র কৃষ্ণের কারণে। তবুও মানুষের কথাকে উপেক্ষা করে যেটুকু চাল বা টাকাও ভিক্ষে পায় পুত্র কৃষ্ণ সে টাকা দিয়েও নেশা করে। বৈশাখীর সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে একদিন প্রার্থনায় ভগবানের কাছে আর্জি করে এমন পুত্রের দরকার নেই আমার। হে ভগবান এই পুত্রের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করো আমায়। এ অভিশপ্ত জীবন চাইনা আমি। এভাবে প্রার্থনা করলে পরেরদিন থেকে বৈশাখীর পুত্র কৃষ্ণ কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব কথা বলতে বলতে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল বৈশাখীর। কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল রাখাল স্যার। বৈশাখীর চোখে অশ্রু দেখে রাখাল স্যারের চোখ দিয়েও অশ্রু বেরিয়ে আসে। কোনো কথা না বাড়িয়ে রাখাল স্যার শুধু এতটুকু বলে, আচ্ছা দিদি এখন তো আপনার কেউ নেই বললেই চলে, পুত্র নেই, স্বামী নেই, সম্পত্তি নেই, শুধু আছে ঘুমানোর জন্য একটা ঘর। উপার্জনের ও কোন রাস্তা নেই ভিক্ষে ছাড়া। আমি যদি বলি আপনাকে আর ভিক্ষে করতে হবেনা, আবার আপনাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেবো। যা দিয়ে সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করবেন, এমনটা হলে কেমন হয়? এ কথা শোনামাত্রই বৈশাখীর চোখেমুখে যেন হাসি ফুটে ওঠে। আনন্দে গদগদ হয়ে যায়, কিছু বলতে পারেনা বৈশাখী। রাখাল স্যার বৈশাখীর হাতে একটা ১ হাজার টাকার নোট দিয়ে বলে, দিদি আজ থেকে আর ভিক্ষে করবেন না আপনি। আগামী শুক্রবার ঠিক এই সময়ে আপনার বাড়িতে আসবো সেলাই মেশিন নিয়ে। কি দিদি আপনি খুশি তো? একটা আনন্দের হাসি দিয়ে শুধু মাথা নাড়লো বৈশাখী। বৈশাখী চলে গেলে ছাত্রীরা রাখাল স্যারকে জিজ্ঞেস করে স্যার, বৈশাখী আপনার কে হয়? রাখাল স্যার কথাটা শোনামাত্রই যেন কান্নায় ভেঙে পরে। কান্না করে আর বলতে থাকে, বৈশাখী সে যে আমার-ই আপন দিদি। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, দিদি তখন পড়ে ক্লাস থ্রি তে। চৈত্রের দাবদাহে যখন সবাই অতিষ্ট, তখন আমি কান্না শুরু করি মেলায় যাওয়ার জন্য। কেউ আমাকে মেলায় না নিয়ে গেলে বৈশাখী দিদি আমাকে মেলায় নিয়ে যায়। সেখানে যেয়ে আমি হারিয়ে যাই, তারপর সে কি কান্না। দিদিকে না পেয়ে যখন আমি মেলার পাশে বিশাল বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলাম তখন এক ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে যেয়ে লালিতপালিত করে, ভালো স্কুল কলেজে লেখাপড়া করিয়ে আমাকে এতদূর এনেছে। অনেক খুঁজেছি দিদিকে, কিন্তু কোথাও পাইনি। বড় হয়ে যখন বুদ্ধি হলো তখন বাবা-মা’র খোঁজ ও করেছি। কিন্তু বাবা-মা আর বেঁচে নেই। যখন দিদিকে দেখলাম সে তো তোমরাই দেখলে কেমন মুমূর্ষু অবস্থা দিদির। ছাত্রীরা জিজ্ঞেস করলো স্যার, যদি বৈশাখী রানী আপনার দিদি-ই হবে তাহলে আপনার পরিচয় দিলেন না কেন? তখন স্যার বলে ওঠে পরিচয় নিশ্চয়ই দেবো যেদিন দিদিকে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবো। পরের শুক্রবার রাখাল স্যার ও ছাত্রীরা মিলে সেলাই মেশিন নিয়ে যখন বৈশাখীর বাড়িতে উপস্থিত, তখন রাখাল স্যার দেখতে পায় তার দিদি তাদের জন্য রান্না করেছে। কিন্তু রাখাল স্যার খাবার না খেয়ে দিদিকে সেলাই মেশিন দিয়ে বললো, আমি সেদিন-ই তোমার বাড়িতে আহার করবো যেদিন তুমি পূর্বাবস্থায় চলে যাবে। সেলাই মেশিন পেয়ে বৈশাখী দারুণ খুশি। একজনের সংসার, সংসারে কেউ নেই। কোনো ঝামেলা নেই। সেই আগের মতোই আবার প্রতিবেশীদের জামা কাপড় সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন বৈশাখী। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এ বয়সেও তিনি অনেক উদ্যমী। তার মনটা এখন বেশ ফুরফুরে। নেশাগ্রস্ত পুত্রের চিন্তা নেই, সম্পত্তি হারাবার চিন্তা নেই। পরাজিত হয়েও যেন বৈশাখী অপরাজিত জীবন যুদ্ধের এক সাহসী যোদ্ধা।